চার আনার রসিকতা
চার আনার রসিকতা
December 10, 2016, 1:23pm
সম্পাদকীয়
অর্থনীতির যখন নাভিশ্বাস উঠিতেছে, অর্থমন্ত্রীর উদ্বেগ স্বাভাবিক। তিনি চিকিৎসার ব্যবস্থা করিতে চাহিবেন, তাহাও অস্বাভাবিক নহে। অরুণ জেটলি বহুবিধ দাওয়াই প্রয়োগ করিয়াছেন। যেমন, ক্রে়ডিট বা ডেবিট কার্ড ব্যবহার করিয়া গাড়িতে তেল ভরাইলে প্রতি এক শত টাকায় বারো আনা ছাড়। লোকাল ট্রেনের মান্থলি পাসে ছাড় সামান্য কম— এক শত টাকায় আট আনা। হাইওয়েতে আরএফআইডি কার্ড বা ফাস্ট ট্যাগ-এর মাধ্যমে টোল মিটাইলে সরাসরি দশ শতাংশ মকুব। সাধারণ মানুষ নিশ্চয় ভাবিয়াই আকুল, এত পয়সা বাঁচিয়া গেলে তাহা রাখিব কোথায়? অসংগঠিত ক্ষেত্রের যে শ্রমিকরা গত এক মাস কাজ পান নাই, যে মধ্যবিত্ত প্রতি দিন নিয়ম করিয়া এটিএম আর ব্যাঙ্কে হত্যে দিয়া প়়ড়িয়া থাকিয়াছেন, তাঁহারাও সম্ভবত প্রত্যেকেই উল্লসিত— গাড়িতে তেল ভরিয়া তাঁহারা হাইওয়ে ধরিয়া লং ড্রাইভে যাইবেন। প্রধানমন্ত্রী রুটি কাড়িয়া লইয়াছেন তো কী, তাঁহারা কেক লইয়া যাইবেন। ভবিষ্যতের কোনও গবেষক ভারতীয় অর্থনীতির ইতিহাস চর্চা করিতে করিতে ভাবিবেন, অর্থনীতির কাণ্ডজ্ঞান না থাকুক, দিল্লীশ্বরদের রসবোধটি মোক্ষম ছিল। নচেৎ, অর্থমন্ত্রী সাংবাদিক সম্মেলন ডাকিয়া অর্থনীতির স্বাস্থ্যোদ্ধারের নামে এই রসিকতাগুলি করিতে পারিতেন না।চার আনা-আট আনার ছাড়কেই অর্থমন্ত্রীর একমাত্র রসিকতা ভাবিলে তাঁহার প্রতি অন্যায় হইবে। কৃষকদের জন্য রুপে কিসান কার্ডের প্রতিশ্রুতি ভিন্ন তিনি যতগুলি পদক্ষেপের কথা ঘোষণা করিয়াছেন, কার্যত প্রতিটির অভিমুখ শহরের দিকে, এবং তাহার গতি অপেক্ষাকৃত সচ্ছলদের দিকে। গ্রামের প্রান্তিক চাষি অথবা কৃষিশ্রমিক পকেটে ক্রেডিট কার্ড লইয়া গাড়িতে তেল ভরিতে যান না। অথবা, নির্মাণশিল্পের ঠিকা শ্রমিক অনলাইনে জীবনবিমার প্রিমিয়াম দেন না। শহরের কাজ চলিয়া যাওয়ায় যাঁহারা ট্রেনের অসংরক্ষিত কামরায় ঠাসাঠাসি করিয়া গ্রামে ফিরিতেছেন, তাঁহারা পকেট হইতে স্মার্টফোন বাহির করিয়া রেলের খাবারের দামও মিটাইতে পারেন না। পরিষেবা করের ছাড় উপভোগ করিবার ন্যায় ব্যয়ক্ষমতাও তাঁহাদের নাই। অধুনা ভারতের অন্যতম প্রধান বিভাজনটির নাম ডিজিটাল বিভাজিকা। যাঁহারা সেই বিভাজিকার সুবিধাজনক দিকটিতে আছেন, জেটলি সামান্য হইলেও তাঁহাদেরই কিছু বাড়তি সুবিধা করিয়া দিলেন। আর, নোট নাকচের গোলায় যাঁহার সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত, অর্থমন্ত্রী আরও এক দফা তাঁহাদের বিস্মৃত হইলেন। অরুণ জেটলিরা সম্ভবত স্থির করিয়া লইয়াছেন, যাঁহাদের স্মার্টফোন নাই, তাঁহারা নাগরিক নহেন। ইহা মোক্ষমতর রসিকতা।স্মার্টফোনকেই নাগরিকত্বের অভিজ্ঞান ভাবিয়া বসিবার মধ্যে নির্বুদ্ধিতা কতখানি, বিজ্ঞজনেরা বিচার করিবেন। কিন্তু, ভারত নামক দেশটির সহিত অপরিচয় কতখানি গভীর হইলে এই সিদ্ধান্তগুলি করা যায়, এক্ষণে তাহা ভাবিবার। গত এক মাস যাবৎ নরেন্দ্র মোদীরা শুনিতেছেন, সাধারণ মানুষের কষ্ট ক্রমে বাড়িতেছে। ভোট বড় বালাই, ফলে কষ্ট কমাইবার তাগিদ তাঁহাদের থাকাই স্বাভাবিক। কিন্তু, সেই কষ্ট কী, কীসে তাহার উপশম হয়, সেই কথাগুলি বুঝিতে হইলে দেশটিকে জানিতে হয়। ফেসবুক-হোয়াটসঅ্যাপে যাঁহারা সরকারের সমর্থনে গলা ফাটাইয়া চলিতেছেন, তাঁহারাই যে ‘দেশ’ নহেন, এই কথাটি বুঝিতে হয়। যেখানে দেশের সিংহভাগ মানুষের ‘ক্যাশলেস’ ‘ডিজিটাল’ দুনিয়ায় প্রবেশাধিকারই নাই, সেখানে গোড়ার সমস্যাটির সমাধান না করিয়া ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারকারীদের চার আনার সুবিধা করিয়া দেওয়ার রসিকতা শুধু অলীক নহে, অশালীনও। অর্থমন্ত্রী দয়া করিয়া নিজের রসবোধ সংবরণ করুন
- এ-সব-হচ্ছেটা-কী-সাংসদদের-ধমক-দ
- প্রবল-শক্তিতে-ধেয়ে-আসছে-ঘূর্ণি
Comments