বাঘের গুহা : সুব্রত দাস
বাঘের গুহা : সুব্রত দাস
March 22, 2021, 8:19pm
ভ্রমণ
কথায় বলে, যেখানে বাঘের ভয় সেখানে সন্ধ্যা হয় । আমরা বলি, যেখানে বাঘের ভয় , সেখানে গল্পের শুরুও হয় । এমনই বাঘের ভয় নিয়েই এই গল্পের অবতারণা । মাঘ মাসের এক বৃষ্টিমুখর দুপুরবেলায় দাদুর মুখে গল্প শুনে শিশু মনে বাঘের ভয়ের উদ্রেক। উত্তরাখণ্ডের কোনও এক গুহার ভিতর থেকে ভেসে আসা গাড়োয়ালি সুর । আবারও এক দুপুর, পকেটে কুড়নো কিছু খুচরো পাথর । আবার সেই বাঘের ভয়... লিখছেন সুব্রত দাস (অতীত বিলাসী)
একে মাঘ মাস । তার উপর মেঘলা দিন । তাই শীতটাও পড়েছে বেশ জাঁকিয়ে । ভরদুপুরে নুন- ঝাল তৈরি করে বেরিয়ে পড়েছি কুল কুড়োতে । দুই পকেট ভরে কুল কুড়িয়েছি । এরইমধ্যে বৃষ্টি শুরু হল টিপটিপ করে । হঠাৎ এক বৃদ্ধের কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম । তাকিয়ে দেখি পাল দাদু । হাত নেড়ে বলছেন "এই বৃষ্টিতে ভিজিস না । চালার ভেতরে এসে বোস" ।
ততক্ষণে বৃষ্টির জোর বেড়েছে । তাই অগত্যা চালার ভেতরেই এসে বসতে হলো । চালা বলতে এটা পাল দাদুর কাজের জায়গা । এখানে উনি মাটির নানা ধরনের পাত্র তৈরি করেন। ভেতরে এসে দেখলাম যাবতীয় কাঁচা মাটির সামগ্রী পাকা হওয়ার প্রত্যাশায় অপেক্ষারত। আমাকে বসতে দিলেন কাঠের গোলাকৃতি একটা মোড়ার উপরে । এটি গরুর গাড়ির চাকার মাঝের অংশটি দিয়ে তৈরি ।
চালার ভেতরটা বাইরের থেকে অপেক্ষাকৃত অন্ধকার । আর আজ বাইরে মেঘলা বলে যেন একটু বেশিই আলো-আঁধারি মনে হচ্ছে। মাটির দেওয়াল ও মেঝে বেশ স্যাঁতস্যাঁতে । প্রচুর বন তুলসির ডাল জ্বালানি হিসেবে রাখা হয়েছে স্তূপ করে। তার দরুন একটা বুনো গন্ধ ভেসে আসছে । পাল দাদু নিজে ছোট্ট একটা আগুন করে তার সামনে বসে বসে তামাক খেতে লাগলেন । শুকনো বন-তুলসীর ডাল জ্বালানোর জন্য সেই বুনো গন্ধটা আরো প্রকট হল । সঙ্গে হালকা একটা নীলচে ধোঁয়ায় সারা চালাও ভরে উঠলো ।
পাল দাদু নানা প্রাসঙ্গিক অপ্রাসঙ্গিক গল্প বলতে লাগলেন । এই সময় মাঠে কাটা ফসল ও সরষে রয়েছে তার কি ক্ষতি হতে পারে ? খুব বড় কাঁঠাল গাছের গোড়ার মাটির তলাতেও কাঁঠাল হয় - পরে সেখানে মাছি ভনভন করলে বোঝা যায় সেখানে কাঁঠাল পেকেছে । দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বোমারু বিমান থেকে বোমা পড়লে তার সেই ভীষণ আওয়াজে বাড়ির আলমারির কাচ ভেঙে যেত । এরকম অনেক ছোট ছোট গল্পের কোলাজে দুপুরটা ভরে উঠলো।
এরই মধ্যে একটা গল্পে রোমাঞ্চিত হলাম - অনেকদিন আগে পাল দাদুদের বাপ ঠাকুরদার আমলের এই চালার আশেপাশে প্রচুর ঘন জঙ্গল ছিল । তখন এখানে বাঘের উপদ্রব ছিল । পাল দাদুর মুখে এই গল্প শুনে শিশুমনে একটু ভয় হল। যদি এখনই এই বৃষ্টিতে এই চালারই দাওয়াতে বাঘ এসে দাঁড়ায় ।
এরপর প্রায় বছর পনেরো কেটে গিয়েছে । মনের ইচ্ছে গুলো ডানা মেলতে শুরু করেছে । তেমনই এক ইচ্ছেডানায় ভর করে চলে এসেছি হর কি দুন ট্রেকিংয়ে - আর এক মেঘলা দুপুরবেলায় । উত্তরাখণ্ডের মরিন্ডা তালের ধারে দাঁড়িয়ে রয়েছি , বেশ শীত । চারিদিক থেকে কনকনে হাওয়া আসছে । কুয়াশায় চারিদিক ঝাপসা। তালের চারপাশে নানা রঙের ছোট ছোট নুড়িপাথর পড়ে রয়েছে । সেগুলো কুড়িয়ে দু-পকেটে ভর্তি করে ফেলেছি। এরই মধ্যে বৃষ্টি শুরু হল । বৃষ্টি নয়, স্নোফল । হঠাৎ এক হিন্দিভাষী পৌড়ের কন্ঠস্বর শুনতে পেলাম । তাকিয়ে দেখি বিসান সিং রানা - " আরে দাদা বাহার মৎ খড়ে রহো , মেরে সাথ চলে আও"। ইচ্ছে না থাকলেও আমরা তাঁকে অনুসরণ করলাম । কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা ছোট্ট গুহার কাছে পৌঁছলাম ।
বিসান সিং গুহার ভেতরে প্রবেশ করল । তারপর বেরিয়ে এসে আমাদের ইশারা করলো। এবার আমরা গুহার ভেতরে ঢুকলাম। ভেতরটা বাইরে থেকে অপেক্ষাকৃত অন্ধকার, স্যাঁতস্যাঁতে এবং আঁশটে গন্ধে ভরা। বিসান সিং আমাদের বসতে বলল । ছোট ছোট বোল্ডারের উপরে আমরা বসলাম। বিসান সিং গুহার সামনে বসল । বাইরে থেকে ভিজে ডালপালা এনে আগুন জ্বালানো হল । গুহার ভেতরটায় পাহাড়ি নাম-না-জানা ডালপালা জ্বলার ফলে এক বুনো গন্ধে এবং হালকা নীল ধোঁয়ায় ভরে উঠলো । বাইরে স্নোফল বেড়ে চলেছে । ভেতরে নানা প্রাসঙ্গিক অপ্রাসঙ্গিক গল্পে গুহার ভেতর জমিয়ে দিল বিসান সিং ।
গাড়োয়ালি ভাষায় গান শোনালো সে । এদিকে সেই ছোট আগুনের ভিজে কাঠের ধোঁয়ায় আমাদের প্রাণ ওষ্ঠাগত। আমরা তাকে অনুরোধ করলাম, আগুনটা নিভিয়ে দিতে ।তখন বিসান সিং বলল- এই গুহাগুলোতে এই স্নোফল এর সময় বাঘও আসতে পারে । তাই এই আগুনের ধোঁয়া করা । যাতে, বাঘের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায় ।এই কথা শুনে আমরা সবাই নড়েচড়ে বসলাম । আর ঠিক তখনই আমার সেই অতীতের দুপুরের মুহূর্তটা মনে পড়ে গেল।
আজ এই লকডাউনে ফেলে আসা দিনগুলো বড় বেশী মনে পড়ে । আর এইরকম আশ্চর্য পাহাড়ি অনুষঙ্গগুলো যখন তখন আঁকড়ে ধরে।
Keywords : Cave, Tiger, Experience, Travel, Tourism
Comments