চৈতালি ঘোষ, শিক্ষিকা, ইংরাজি
২০২১ এর মাধ্যমিক –উচ্চমাধ্যমিকের মূল্যায়ন ও কিছু প্রশ্ন: চৈতালি ঘোষ
August 7, 2021, 9:08pm
বিনোদন
"...দীর্ঘদিন বিদ্যালয়ে আসতে না পারা, বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে দেখা না হওয়া, প্রায় গৃহবন্দি জীবন কাটানো, জীবনের প্রথম বড় পরিক্ষা দিতে না পারা এবং তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে অজানা আশঙ্কা – এই সব কি তাদের জন্য যথেষ্ট শাস্তি নয় ? তারপরেও তাদেরকে অপরাধীর কণ্টকাসনে বসানো, উপহাসের পাত্র করে তোলা কি স্বাভাবিক, সুস্থ, মানসিকতার পরিচয় ? ..." - লিখছেন চৈতালি ঘোষ, শিক্ষিকা, ইংরাজি, বোদাই উচ্চ বিদ্যালয়
গত ২০২০-র ২২শে মার্চ থেকে পশ্চিমবঙ্গ তথা সমগ্র দেশ করোনা অতিমারিতে জরাজীর্ণ । সামগ্রিক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাপ সম্ভব নয় । তবে শিক্ষাব্যবস্থা চরম ক্ষতির সম্মুখীন । ক্ষতিগ্রস্ত অগণিত ছাত্রছাত্রী । এরই মধ্যে আমাদের রাজ্যের শিক্ষাপর্ষদ একটি মূল্যায়ণের প্রক্রিয়া তৈরি করে । ২০ জুলাই মাধ্যমিক এবং ২২ জুলাই উচ্চমাধ্যমিকের ফলপ্রকাশ করে ।
মাধ্যমিকের ক্ষেত্রে নবম শ্রেণীতে প্রাপ্ত নম্বরের ৫০ শতাংশ এবং ১০ নম্বরের প্রজেক্টের নম্বর যোগ করা হয়েছে । এক্ষেত্রে শিক্ষক শিক্ষিকাদের হাতে যেহেতু ঐ ১০ নম্বর ছিল, স্বভাবতই তাঁরা পড়ুয়াদের কথা ভেবে যত বেশি দেওয়া যায় তা দিয়েছেন ।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০২১এ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ১০,৭৯,৭৪৯ জন । পাশের হার ছিল ১০০ শতাংশ । তাদের মধ্যে ৬৯৭ পেয়ে প্রথম স্থানাধিকারির সংখ্যা ছিল ৭৯জন । এই ফলপ্রকাশের পরই রাজ্য জুড়ে উঠল সমালোচনার ঝড় । সোশ্যাল মিডিয়ার দেওয়াল জুড়ে শুধুই ব্যঙ্গ রসাত্মক মিম (Memes) । পরীক্ষা না দিয়ে পাশ করার এবং না পড়ে বেশি নম্বর পাওয়ার অপরাধে পড়ুয়াদের কাঠগড়ায় তুলল একশ্রেণির ফেবুপন্ডিতের দল । বাদ গেলেন না শিক্ষক – শিক্ষিকারাও । চায়ের দোকান থেকে আটচালার আড্ডা – সর্বত্র চর্চিত চর্বণ হয়ে উঠল এই বিষয় ।
আমরা ভাবতে একপ্রকার ভুলেই গেলাম - যাদের নিয়ে এই তামাশা, তাদের অপরাধ কোথায় ? এই পড়ুয়ারা কি বলেছিল , তারা পরীক্ষা দেবে না ? যথোপযুক্ত টিকাকরণের ব্যবস্থা করতে না পারায় স্কুল-কলেজ বন্ধ রাখা এবং পরিক্ষা না হওয়ার ব্যর্থতার জন্যও কি তারাই দায়ী ?
দীর্ঘদিন বিদ্যালয়ে আসতে না পারা, বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে দেখা না হওয়া, প্রায় গৃহবন্দি জীবন কাটানো, জীবনের প্রথম বড় পরিক্ষা দিতে না পারা এবং তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে অজানা আশঙ্কা – এই সব কি তাদের জন্য যথেষ্ট শাস্তি নয় ? তারপরেও তাদেরকে অপরাধীর কণ্টকাসনে বসানো, উপহাসের পাত্র করে তোলা কি স্বাভাবিক, সুস্থ, মানসিকতার পরিচয় ?
আবার এই শিক্ষিত সমাজ এবং ফেবুপণ্ডিতদের সম্পূর্ণ ভিন্ন রূপ দেখা গেল উচ্চমাধ্যমিকের ফলপ্রকাশের পর । এবারের মোট পরিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ৮ লক্ষ ১৯ হাজার ২০২ জন, কৃতকার্য – ৯৭.৬৯% । এই কৃতকার্জ পরিক্ষার্থীর মধ্যে ৯০১৩জন ৯০% এর বেশি এবং ৪৯৩৭০ জন ৮০ শতাংশের বেশি নম্বর পেয়েছে । এবারের প্রশ্নটা তাদের নিয়ে নয়, সেই ০২.৩১% অসফল ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে । এবারেও কাঠগড়ায় শিক্ষক – শিক্ষিকারা । তবে অভিযোগ সম্পূর্ণ উল্টো । হাতে রেখে বা চেপে নম্বর দেওয়ার অভিযোগ ।
উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষাপর্ষদ এর তৈরি করা নিয়ম অনুযায়ী উচ্চমাধ্যমিকের মূল্যায়ণ হয়েছে মাধ্যমিকে পাওয়া সর্বোচ্চ চারটি বিষয়ের ৪০% নিয়ে এবং একাদশে প্রাপ্ত নম্বরের ৬০% নিয়ে । তার সঙ্গে আছে প্রজেক্ট । এক্ষেত্রে মনে রাখা দরকার ছাত্র-ছাত্রীরা যখন দশম থেকে একাদশে ওঠে তখনই তারা মনের দিক থেকে হঠাৎই অনেকটা বড় হয়ে গিয়েছে বলে মনে করে । ফলে পড়াশোনার থেকে অনেকে অনেকটাই দূরে চলে যায় । আর তাই একাদশে বহু ছাত্রছাত্রীই অকৃতকার্জ হয় । তাই প্রজেক্টে শিক্ষক শিক্ষিকারা ‘ঢালাও’ নম্বর দিলেও তাদের পাশ করানো সম্ভব হয় নি । ফলস্বরূপ বিভিন্ন স্কুলে প্রতিরোধ , ভাঙচুর এমনকি বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে শারীরিক হেনস্থার ও শিকার হতে রয়েছে ।
এই দুই মূল্যায়ণকে ঘিরে আমার কিছু প্রশ্নঃ
দুই ক্ষেত্রেই ছাত্রছাত্রী বা শিক্ষক সমাজ কীভাবে দায়ী ? আমাদের রাজ্যের নেতা-মন্ত্রীদের প্রতি যথেষ্ট সম্মান রেখেই জানতে চাইছি, রাজ্যের প্রায় সাড়ে ৫ কোটি ভোটারের যদি আট দফায় ভোট করতে পারা যায়, তাহলে ১৯ লক্ষ পরিক্ষার্থীর জীবনের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ নির্ণায়ক পরীক্ষা দুটো নেওয়ার ব্যবস্থা কি করতে পারতেন না তাঁরা ? বিগত দেড় বছর ধরে যে ভয়াবহ অতিমারির মধ্য দিয়ে আমরা যাচ্ছি তাতে শিক্ষাব্যবস্থা এবং ছাত্রছাত্রীদের ভবিষ্যৎ অত্যন্ত বিপন্ন ।
রাজ্যের প্রতিটি শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষের কাছে আমার বিনীত আবেদন – আসুন না, আমরা রাজনীতির ঊর্ধ্বে গিয়ে আমাদের ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যৎ নিয়ে একটু ভাবি । তাদের কপালে যেন এই তকমা না সাঁটিয়ে দিই , যে তারা পরীক্ষা না দিয়ে পাশ করে যাওয়া ব্যাচ ।
Keywords : Madhyamik, HS, Result, 2020-21, Covid-19
- bombaybegums-শৈশবের-জলাঞ্জলি-ন
- বসন্তের-আগেই-কোকিলহারা-দেশ-ছুট
Comments